সোমবার, ২৭ মে, ২০১৩

দুর্ভাগা দেশ


হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
              মানুষের অধিকারে
              বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
              বিধাতার রুদ্ররোষে
              দুর্ভিক্ষের-দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।
              চরণে দলিত হয়ে
              ধূলায় সে যায় বয়ে -
সেই নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ।
অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।

যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
              অজ্ঞানের অন্ধকারে
              আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার,
মানুষের নারায়ণে তবুও কর না  নমস্কার।
              তবু নত করি আঁখি
              দেখিবার পাও না কি
নেমেছে ধূলার তলে হীনপতিতের ভগবান।
অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান।

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে -
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।
              সবারে না যদি ডাকো,
              এখনো সরিয়া থাকো,
আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান -
মৃত্যু-মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।

আমাদের ছোট নদী

 

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।

চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।

আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ই মে কলকাতার এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিঁনি ছিলেন অগ্রণী বাঙ্গালী কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, কন্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ্য সাহিত্যিক মনে করা হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদের জন্য তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইউরোপের বাহিরের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসাবে তিনি বিশ্বে ব্যপক খ্যাতি লাভ করেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ই অগাস্ট জোড়াসাঁকোর বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত তিঁনি সৃষ্টিশীল ছিলেন।